সোমবার, ১৬ আগস্ট, ২০২১

তালেবানের কাবুল দখলের মুহুর্তে যেভাবে শহরটা ছেড়ে এলাম

 মার্কিন একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হয়ে গত কয়েক বছর ধরে আফগানিস্তানে কর্মরত ছিলেন সোহিনী সরকার।


সে দেশে চলমান সংঘাতের আঁচ থেকে কীভাবে বেসামরিক মানুষজনকে রক্ষা করা যায় ('কনফ্লিক্ট মিটিগেশন') তা নিয়েই দীর্ঘদিন ধরেই কাজ করছেন তিনি।

রবিবার (১৫ই অগাস্ট) তালেবানের হাতে কাবুলের পতনের দিনেই এয়ার ইন্ডিয়ার শেষ বিমানে রাতে দিল্লিতে এসে নেমেছেন তিনি।

১৫ই অগাস্ট যে দিল্লি ফিরব সেটা জানা ছিল দিনকয়েক আগে থেকেই। টিকিটও বুক করা ছিল আগেই, কিন্তু সে দিনই যে তালেবান শহরটা দখল করে নেবে তা ঘুণাক্ষরেও আঁচ করতে পারিনি।

রবিবার সকালেই বজ্রপাতের মতো খবর এলো তালেবান নাকি পিডি-ফাইভে ঢুকে পড়েছে, যে এলাকাটা আমাদের অফিসের বেশ কাছেই। পুরো কাবুল শহরটা এরকম বারো-তেরোটা 'পুলিশ ডিস্ট্রিক্ট' বা পিডি-তে ভাগ করা, তার মধ্যে পাঁচ নম্বরটা আমাদের সবচেয়ে কাছে - আর তালেবান রাজধানীতে প্রবেশ করে সেই পথেই।

বিকেলে ফেরার ফ্লাইট থাকলেও জরুরি কিছু কাজকর্ম সারতে রোববার সকালেও অফিসে গিয়েছিলাম। স্থানীয় কর্মীরাও যথারীতি কাজে এসেছিলেন, এর মধ্যে তালেবানের ঢুকে পড়ার খবর আসতেই স্টাফদের তড়িঘড়ি বাড়ি ফেরার নির্দেশ দেওয়া হল।

আমাদের জনাকয়েক কর্মী টাকাপয়সা তুলতে ব্যাঙ্কেও গিয়েছিলেন। তারা এসে খবর দিলেন, সব ব্যাঙ্কেই না কি টাকা ফুরিয়ে গেছে - এটিএম বা ব্রাঞ্চ থেকে কোনও টাকা তোলাই যাচ্ছে না।

ঠিক তখন থেকেই দেখলাম সবার মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে, ভয়ে সবার মুখ শুকিয়ে আসছে।



শেষ মুহুর্তের ব্যস্ততা, সহকর্মীদের জন্য খারাপ-লাগা

এর মধ্যেই মার্কিন দূতাবাস থেকে আমাদের কাছে নির্দেশ এল, স্টেশন ছাড়ার আগে সমস্ত সেন্সিটিভ ডকুমেন্টস, কর্মীদের নামধাম-পরিচয় এইসব সরিয়ে ফেলে তাদের কাছে পাঠিয়ে দিতে হবে - সেগুলোও সারতে হল নীরবে।

একটা ভীষণ খারাপলাগা কাজ করছিল সর্বক্ষণ ... আমি প্রায় ২০০জন স্থানীয় আফগানের সঙ্গে এতদিন কাজ করছি, তাদের একটা প্রবল বিপদের মধ্যে রেখেই আমাকে চলে যেতে হচ্ছে।

অথচ তারা চাইলেও এখান থেকে চলে যেতে পারছেন না।

কাবুলের বাসিন্দাদের মধ্যে অনেকেই ভারতে ফিরতে আগ্রহী ছিলেন, কিন্তু ততক্ষণে ভারতও ভিসা দেওয়ার প্রক্রিয়া বন্ধ করে দিয়েছে।

আর আমরা রবিবার রাতে যখন কাবুল ছাড়ছি, তখন ভারতের দূতাবাস কার্যত বন্ধই বলা চলে।

এই সবের মধ্যেই অবশেষে এয়ারপোর্টের দিকে রওনা দিলাম। এমনিতে আমি থাকি এয়ারপোর্টের বেশ কাছেই, মাত্র দশ মিনিটের ড্রাইভ - কিন্তু কাল সময় লাগল আধঘন্টারও বেশি।

কারণ ততক্ষণে কাবুল বিমানবন্দর অভিমুখী সব রাস্তায় মারাত্মক যানজট শুরু হয়ে গেছে। কাবুল শহরের সব গাড়ি যেন গিয়ে বিমানবন্দরে ঢুকতে চাইছে।

অনেককে তো গাড়ি থেকে নেমে প্লেন ধরার জন্য স্যুটকেস নিয়ে আড়াই বা তিন কিলোমিটার পথ হাঁটতেও হয়েছে। আমার অবশ্য অতটা ভোগান্তি হয়নি।

তবে এয়ারপোর্টে গিয়ে প্লেন ছাড়ার জন্য অপেক্ষা করতে হল দীর্ঘক্ষণ। বেলা পৌনে তিনটের ফ্লাইট ছাড়ল প্রায় ঘন্টাচারেক পর, দিল্লিতে এসে ল্যান্ড করলাম রাত নটার পর।

আমরা যখন কাবুল এয়ারপোর্ট ছাড়ি, তখনও বিমানবন্দরের পরিস্থিতি একেবারে হাতের বাইরে চলে যায়নি। তারপর থেকে সেখানে যে মারাত্মক হুড়োহুড়ি আর অরাজকতা শুরু হয়েছে, তা তো সবাই দেখতেই পাচ্ছেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন